ঢাকারবিবার , ১৩ জুন ২০২১

রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসের ভয়াবহ সেই দিন আজ! সেনা সদস্য সহ নিহত হয়েছিল ১২০জন

প্রতিবেদক
Admin
জুন ১৩, ২০২১ ৯:১৭ পূর্বাহ্ণ

রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি // রাঙ্গামাটির ভয়াবহ পাহাড় ধসের মর্মান্তিক ঘটনার চার বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৭ সালের ১৩ জুনের রাতে টানা তিনদিনের ভারী বৃষ্টি আর বজ্রপাতে রাঙ্গামাটিতে ঘটে যায় স্মরণ কালের পাহাড় ধসের ঘটনা। বছর ঘুরে দিনটি ফিরে এলে রাঙ্গামাটিবাসীর মনে দেখা দেয় আতঙ্কের সেই ভয়াল স্মৃতি।
পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে একদিনেই প্রাণ হারিয়েছিলেন সেনা সদস্য সহ নারী পুরুষ ও শিশুসহ ১২০ জন। এর মধ্যে শহরের মানিকছড়িতে একটি সেনা ক্যাম্পের নিচে রাঙ্গামাটি – চট্টগ্রাম সড়কের উপর ধসে পড়া মাটি অপসারণ করতে গিয়ে পুনরায় পাহাড় ধসের মাটি চাপা পড়ে নিহত হন ঐ ক্যাম্পের দুই কর্মকর্তাসহ ৫ সেনা সদস্য।
নিহত সেনাসদস্যরা হলেনÑ মেজর মোহাম্মদ মাহফুজুল হক, ক্যাপ্টেন মো. তানভীর সালাম শান্ত, করপোরাল মোহাম্মদ আজিজুল হক , সৈনিক মো.শাহিন আলম, ও সৈনিক মো. আজিজুর রহমান।
জেলা প্রশাসনের হিসাবে রাঙ্গামাটি সদরে ৬৬ জন, জুরাছড়ি উপজেলায় ৬জন,বিলাইছড়ি উপজেলায় ২জন,কাপ্তাই উপজেলায় ১৮জন এবংকাউখালী উপজেলায় ২১ জন মিলে মোট ১১৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে শিশু-৩৩, মহিলা-৩২, পুরুষ ৪৮ জনের মরদেহ পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞ দের মতে অন্য যে কোন পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালের ১৩ জুনের পাহাড় ধসের ঘটনা সেরকম ছিলনা। রাঙ্গামাটি ব্যাপক প্রানহানীর সাথে ব্যাপক ভৌত অবকাঠামো ভিষনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাহাড়ে ঘরবাড়ী আছে এমন পাহাড়ও যেমন ভেঙ্গেছে,ঘরবাড়ী ছিলনা এমন অসংখ্য পাহাড়ও ভেঙ্গে পড়ে। আবার ঝোপ জঙ্গল গাছপালাতে ভরপুর এমন পাহাড়ও ভেঙ্গে পড়ে। এক কথায় সব রকম পাহড়েই মাটি ধস ধসে পড়ে। এটার ব্যাপ্তি, বিস্তৃতিও গভীরতওা অনেক বেশী ছিল ।
টানা তিনদিনের প্রবল বর্ষনে পাহাড় ধসে রাঙ্গামাটির এত লোকের প্রাণহানি, ঘরবাড়ি, সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুতের এত ক্ষতি হবে সেদিন কেউ ভাবতে পারেনি। সে দিন মুহূর্তেই সব দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল পর্যটন শহর রাঙ্গামাটি।
১৩ জুন রাত থেকেই শুরু হয়েছিল প্রচন্ড গগনবিদারী আওয়াজে বজ্রপাতসহ ভারি বৃষ্টি। ভয়ে আতংকে সেই রাত কাটাতে হয়েছিলো রাঙ্গামাটির মানুষকে। ভোর হওয়ার পর রাঙ্গামাটি শহরের ভেদভেদি, মোনতলা, রাঙ্গাপানি, শিমুলতলি, মুসলিম পাড়া ও লোকনাথ মন্দির এলাকা, সদর উপজেলার মগবান ও সাপছড়ি ইউনিয়নসহ ৫ টি উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির খবর আসতে থাকে। সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল ১৩ জুন রাঙ্গামাটিতে। আর কোন দুর্ডোগে রাঙ্গামাটিতে এতো প্রাণহানী ঘটেনি।
পাহাড় ধসে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের শালবন এলাকায় ১০০ মিটার রাস্তা ধসে গিয়ে একেবারে বিলীন হয়ে যায়। দেশের অন্যান্য স্থানের সাথে রাঙ্গামাটি ৯ দিন সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। বিভিন্ন আন্ত সড়কে ১৪৫টি স্থানে সড়কে ভাঙ্গন দেখা দেয়। পাহাড়া ধ্বসের বিপর্যয়ে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক ছাড়াও রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক, রাঙ্গামাটি-বড়ইছড়ি ও রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন হয়ে যায়।
এছাড়া রাঙ্গামাটির বৈদ্যুতিক গ্রীড লাইনের পোল ও লাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে রাঙ্গামাটি শহরের ৩ দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে। সেনাবাহিনী ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীদের দ্রুত প্রচেষ্টায় তিন দিনের মাথায় বিদ্যুৎ ও দশ দিনের মধ্যে রাঙ্গামাটি –চট্টগ্রামে সড়ক যোগাযোগ পুন স্থাপন করা সম্ভব হয়। কাপ্তাই রাঙ্গামাটি নৌ পথে পানি, জ্বালানী তেল ও পন্য পরিবহনসহ লোকজনের চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়।
গৃহ হারা হয়ে রাঙ্গামাটির ১২টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২ হাজারের বেশী মানুষ আশ্রয় নেয়। সেনাবাহিনী আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে পানি ও খাবার সরবরাহ করে।
২০২১ সালে রাঙ্গামাটির ভয়াল পাহাড় ধ্বসের ঘটনার চার বছর পার হলেও এখনো অবস্থার কোন পরিবর্তণ হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো আজও বাস করছেন পাহাড়ের গায়ে। প্রতি বছরের মতো বর্ষার শুরুতেই এবারো জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহরে ও উপজেল গুলোতে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষদের বৃষ্টির সময় নিরাপদে সড়ে যেতে ও আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য ব্যাপক প্রচারণা ও সচেতনতা চালিয়ে যাচ্ছেন। শহরের বেশকিছু স্থানে পাহাড়ের পাদদেশে আরো অসংখ্য বাড়ি-ঘর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তবে পাহাড়ের নীচে বসবাসকারী এখনো কেউই সড়ে যাওয়ার সে প্রস্তুতি নেয়নি।
দিনটির কথা স্মরণ করে এ বছরও রাঙ্গামাটি জেলায় প্রাণহানি এড়াতে আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে।
২০১৭ সালের ১৩ জুনের পাহাড় ধস রাঙ্গামাটির সারফেসটাকে নাড়িয়ে দিয়ে অত্যন্ত নাজুক করেছে যা গত চার বছরেও কাটিয়ে উঠা যায়নি। যে কারণে রাঙ্গামাটির অনেক সরকারী বেসরকারী স্থাপনা. মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তা দোকানপাটসহ সবকিছু অনিরাপদ করে দেয়। রাঙ্গামাটিতে দৃশ্য ও অদৃশ্য অনেক বেশি ক্ষতি করে দিয়ে যায় সেই স্মরণ কালের পাহাড় ধসের এ ঘটনা।

 

সর্বশেষ - অপরাধ